– ইউসুফ আরমান
আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ সালের এ দিনে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলিতে ২৫০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানে প্রচন্ড শক্তিধর সাইক্লোন। লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ব্যাপক ধ্বংসলীলা ঘটে এ অঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড় ও ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় । এসময় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত ছাড়াও ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় । এর বেশী ভাগই হয় উপকূলীয় এলাকা আনোয়ারা, বাশঁখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, হাতিয়া, সসন্দ্বীপ ও কক্সবাজার সদরে । তন্মধ্যে উপকূলীয় চকরিয়া ও পেকুয়ায় মারা যায় ২৫ হাজার শিশুসহ নারী-পুরুষ। পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা ১৯৯১ ‘ম্যারি এন‘ দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই ভয়াল রাতের পর কেটে গেছে ২৫টি বছর ।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ২২শে এপ্রিল ১৯৯১ বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্মচাপের সৃষ্টি হয়। বাতাসে গতিবেগের ও নিম্মচাপের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি ২৪শে এপ্রিল ঘুর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘুর্ণিঝড়ে উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর শক্তি আরও বাড়তে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় এবং গতিবেগ ১৬০ মাইল/ঘন্টায় পৌছায় যা একটি ক্যাটাগরী-৫ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে ১৫৫ মাইল/ঘন্টা বেগে আঘাত করে যা ক্যাটাগরী-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে আক্রমনের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০শে এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়। ২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এ সারা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি এবং মানুষ মারা যায় দ্বীপ কুতুবদিয়ায়।
২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ সালের ভয়ংকর এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আর এতে লন্ডভণ্ড হয়ে যায় পূরো উপকূল। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। উপকূল বাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি।
শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ২৫ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা অনেকে মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। এই ঘুর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখনো বাঁশখালীর ১৮ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই। তাই আতঙ্কে আছেন লক্ষাধিক মানুষ। এ উপজেলার বড়ঘোনা, সরল, ছনুয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, ইলশা, প্রেমাশিয়া এলাকার মানুষ এখনো প্রতি বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটান।
এই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকেরা। স্বজন হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদে হাতিয়ার বাসিন্দারা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও উপকূলীয় মানুষের সুরক্ষায় নেয়া হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দ্বীপের চারপাশে নির্মাণ করা হয়নি মজবুত কোনো বেড়িবাঁধ। তাই প্রতি বছর জোয়ার ও বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় দ্বীপের শতশত একর জমির ফসল। সাগরে কোনো লঘুচাপ, নিম্নচাপ কিংবা মেঘ দেখলেই আতঙ্কে চমকে ওঠেন উপকূলবাসী। ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বাঁধসমূহ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এমনকি চট্টগ্রাম শহর রক্ষাবাঁধের বিরাট অংশ এখন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে নেয়া পরিকল্পনার মধ্যে স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হলেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সমূহের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলে যে পরিমাণ সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাও করা হয়নি। তার ওপর বিদ্যমান সাইক্লোন শেল্টারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। কোথাও কোথাও সাইক্লোন শেল্টার সাগর ও নদী ভাঙনের কারণে অস্তিত্ব হারিয়েছে। যার কারণে ২৫বছর পরেও উপকূল আজও নিরাপদ নয়।
কক্সবাজারের দ্বীপ-উপজেলা কুতুবদিয়ার ওপর বয়ে যায় স্মরণকালের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। ৩/৪ ঘণ্টার স্থায়ী তা-বে দ্বীপের নারী-পুরুষ ও অবুঝ শিশুসহ প্রাণ হারায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এই মহাদুর্যোগের দু’টি যুগ অতিবাহিত হলেও দ্বীপবাসীর মাঝে এখনো কাটেনি শোকের ছায়া। হয়ত ১৯৯১ আগের প্রজন্ম একদিন নিঃশেষ হয়ে গেলে এটি রুপকথার গল্প হিসেবেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে অযুতকাল। বৈশাখ মাসের ভ্যাপসা গরম, শুকনো ছিল পুকুর-খন্দক। খাল-বিল ফেটে চৌচির। আবহাওয়ার গুমোট অবস্থা। সোমবার দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসে, বাতাসের গতিবেগ ততই বাড়তে থাকে। রেডক্রিসেন্টে কর্মীরা প্রচার করতে থাকে দুর্যোগের খবর।
১৯৬০ সনের ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘ প্রায় ৫৬বছরো এতো ভয়ঙ্কর তুফান হতে পারে তা মানুষ বুঝতে পারেনি। সে কারণে তেমন আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি মানুষ। রাত ৮টার দিকে শুরু হয় প্রচ- ঝড়োহাওয়া। তখন কোথাও বেরুবার শক্তি ছিল না মানুষের। ঠিক রাত সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে তীব্র গতিতে লোকালয়ে ওঠে আসে বঙ্গোপসাগরের সমস্ত পানি। সাগর-তীর একাকার হয়ে যায় প্রায় ৩ ঘণ্টা। তখন ঘরের ছাদ ও গাছপালায় আশ্রয় নেয় মানুষ। পূর্ণ জোয়ার হওয়ার সাথে সাথে আকাশ ছোঁয়া পরপর ৩টি ঢেউ মানুষের বাঁচার শেষ আশ্রয় থেকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে সলিল সমাধি ঘটে দ্বীপের ২০ হাজার মানুষের। সেই সাথে গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী ও জীব-জন্তুর মৃত্যুসহ বিধ্বস্ত হয় সমস্ত ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট ও দ্বীপ রক্ষা বাঁধ। লন্ড-ভন্ড করে দেয় দ্বীপবাসীর স্বপ্ন। ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘদিন পরেও নির্মাণ করা হয়নি টেকসই দ্বীপ-প্রতিরক্ষাবাঁধ ও পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। ১৯৯১’র মতো কোন দুর্যোগের সৃষ্টি হলে আশ্রয়নের অভাবে আবারো প্রচুর প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন অনেকে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।